কী কী অনিয়ম নজরে এসেছে সিবিআইয়ের?(CBI)
ময়নাতদন্ত ঘিরে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসামঞ্জস্য নজরে এসেছে সিবিআইয়ের (CBI)। প্রথমত, আরজি করের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক প্রবীর চক্রবর্তীকে বাদ দিয়ে ওই বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় ওই বিভাগেরই অধ্যাপক, এক সন্দীপ ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাসকে। অথচ প্রথা অনুযায়ী, এই ধরনের সংবেদনশীল ঘটনায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিভাগীয় প্রধানকেই করার কথা। আর দ্বিতীয়ত, এই মেডিক্যাল বোর্ডে এনআরএসের ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মলি বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করার এক্তিয়ারই ছিল না আরজি করের উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ঠের। অন্য হাসপাতালের কাউকে বোর্ডে রাখতে গেলে আদেশনামা জারি করার কথা স্বাস্থ্য অধিকর্তা কিংবা স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার। এছাড়া ৯ অগাস্ট সকালে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয় আরজি করের ক্যাজুয়াল্টি বিল্ডিংয়ের চারতলার সেমিনার রুম থেকে। আর তাঁর দেহের ময়নাতদন্তের জন্য বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ মেডিক্যাল বোর্ড গড়েন আরজি করের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ তথা সুপার সন্দীপ ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় বশিষ্ঠ। এই বোর্ডের সদস্য ও চেয়ারম্যান নির্বাচন নিয়েও সিবিআই আধিকারিকরা অবাক! কারণ মূলত দু'টি। এবং সেই দু'টি বিষয়কেই নিয়ম বহির্ভূত বলে উল্লেখ করে ইতিমধ্যেই সিবিআই-কে চিঠিও দিয়েছে চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের সদস্যরা।
ময়না তদন্ত নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
সিবিআইয়ের (CBI) একটি সূত্র জানাচ্ছে, সাধারণ নিয়মে বিকেল চারটের পর ময়নাতদন্ত হয় না, যদি না আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা থাকে কিংবা মরণোত্তর অঙ্গদানের ব্যাপার থাকে। বিশেষ করে যদি খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির মতো ঘটনার সন্দেহ থাকে, তা হলেও আরও তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত করার কথা নয়। অথচ সেই নিয়ম মানা হয়নি। যদিও এ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। ২০২১-এর ১৫ নভেম্বর কেন্দ্রের ইস্যু করা সেই নির্দেশিকার (ফাইল নং এইচ-১১০২১/০৭/২০২১-এইচ-১) বিষয়টি নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও একটি আদেশনামা (মেমো নং এম/ ২৪৮৫-৪) জারি করেছিল ওই বছর ২৩ ডিসেম্বরে। সেখানে উল্লেখিত শর্ত পুরোপুরি মানা হয়নি বলেই মনে করছে সিবিআই। চারটের পরে ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে পুলিশের লিখিত অর্ডার চেয়েছিলেন মেডিক্যাল বোর্ডের আর এক সদস্য, আরজি করেরই ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রিনা দাস। তখন টালা থানার সাব-ইনস্পেক্টর লিখিত ভাবে ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। সিবিআইয়ের একটি সূত্রের বক্তব্য, "এমন ক্ষেত্রে একজন সাব-ইনস্পেক্টর কখনই ময়নাতদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন না। ন্যূনতম একজন আইপিএস অফিসারের নির্দেশ জরুরি। কিন্তু সে নিয়মও মানা হয়নি।" ফলে বারবার ফিরে আসছে সেই প্রশ্ন - কেন এত তাড়াহুড়ো!
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট
দিল্লি এইমসের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আদর্শ কুমারের নেতৃত্বাধীন ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল ‘মাল্টি ইনস্টিটিউশনাল মেডিক্যাল বোর্ড’ (এমআইএমবি) আরজি করে নির্যাতিতার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, ময়নাতদন্তের ভিডিওগ্রাফি, সুরতহালের রিপোর্ট এবং এই সংক্রান্ত অন্য প্রয়োজনীয় রিপোর্টগুলি খতিয়ে দেখে। এই সব রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দলকে মোট ৯টি প্রশ্ন করেছিল। সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই রিপোর্টের তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরে লেখা হয়েছে, আরজি করের ঘটনা যে একজনের পক্ষেও ঘটানো সম্ভব। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
উল্লেখ্য, আরজি কর কাণ্ডের তদন্তে নেমে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ। পরে সিবিআইয়ের হাতে মামলা যাওয়ার পর এই ঘটনায় হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু চার্জশিট পেশ করতে না পারায় এই মামলায় সন্দীপ ও অভিজিৎ দুই জনই জামিন পান। তবে অভিজিৎ জেল থেকে মুক্ত হলেও অন্য মামলায় জড়িত থাকায় সন্দীপ এখনও জেলেই রয়েছেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্যাতিতার শরীরের কামড়ের চিহ্ন থেকে যে লালার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল তা ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের লালার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শ্বাসরোধ করেই ওই তরুণীকে খুন করা হয়েছে। পাশাপাশি এই কাণ্ডে ধর্ষণের একাধিক প্রমাণ মিলেছে। তাঁর হাইমেন ছেঁড়া ছিল। সেখান থেকে রক্ত পড়ছিল। শ্বাসরোধের কারণে তাঁর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল বলে মত বিশেষজ্ঞদের। মৃত্যুর আগে তিনি ছটফট করছিলেন বলেও রিপোর্টে দাবি করা হয়। যোনিতে বলপ্রয়োগের ইঙ্গিত মিলেছে। অর্থাৎ জোর করে ভোঁতা কিছু প্রবেশ করানোর চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বীর্য পাওয়া যায়নি। নির্যাতিতা একাধিকবার প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষজ্ঞরা রিপোর্টে আরও দাবি করেন, ময়নাতন্তের সময় কিছু নিয়মভঙ্গ করা হয়েছিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন