Top News

হতে চেয়েছিলেন বডিবিল্ডার, হয়ে গেলেন বিখ্যাত কমেডিয়ান অভিনেতা জানুন তার কাহিনী

 

আজ ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রবি ঘোষের মৃত্যুর ২৭ বছর। এক জন অভিনেতা ২৭ বছর ধরে ‘না ফেরার দেশে’’।

তিনি সত্যজিৎ রায়ের বাঘা। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার তাঁর নাম। বাংলা ছবির কিংবদন্তী অভিনেতা রবি ঘোষ। শুধু কমেডিয়ান বললে তাঁকে সঠিক সম্মান জানানো হয় না। বুদ্ধিদীপ্ত কমেডি অভিনয়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন রবি ঘোষ, যাঁর চোখ কথা বলত। সেই চোখের প্রশংসা করেছিলেন সত্যজিৎ রায় থেকে তপন সিনহা। ১৯৩১ সালের ২৪ নভেম্বর কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। তিনি চলে যান ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।

রবি ঘোষের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বাংলাদেশের বরিশালের লোক। রবি ঘোষের বাবা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা রবির। তারপর দেশভাগ। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেল। ১৯৪৭ সালে কলকাতার 'সাউথ সাবাআরবান মেন স্কুল' থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে রবির সহপাঠী ছিলেন উত্তম কুমারের ছোটভাই তরুণ চট্টোপাধ্যায়, অর্থাৎ অভিনেতা তরুণ কুমার। তখন কে জানত পরবর্তীকালে দুই বন্ধু একইসঙ্গে বাংলা ছবির উজ্জ্বল নক্ষত্র হবেন। রবি ঘোষ এবং তরুণ কুমার একসঙ্গে শুধু ফিল্ম নয়, প্রচুর মঞ্চনাটকও করেছেন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে।

কৈশোর থেকে রবি ঘোষ স্বপ্ন দেখতেন বডিবিল্ডার হবেন। সেভাবেই চলত তাঁর শরীরচর্চা। তাঁর শরীরের গঠন ও সৌষ্ঠব ছিল দেখার মতো। সে সময় হাতে গোনা ক'জনের দুরন্ত ব্যায়াম চর্চিত চেহারা ছিল বলা শক্ত।রবি ঘোষ আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং সেই কলেজেরই নৈশ বিভাগ শ্যামাপ্রসাদ কলেজে বি.কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চা শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। কারণ রবির দু'চোখে তখন শুধু বডি বিল্ডার হওয়ার স্বপ্ন। একটা নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলের বডি বিল্ডার হয়ে ওঠা তখনকার দিনে মুখের কথা ছিল না। অভাবের সংসারে ভাই-বোনদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর নিজের শরীরচর্চা বজায় রাখতে বেশি পুষ্টিকর খাবার, ফল, দুধ এসব খাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা ঘোষদস্তিদার পরিবারের ছিল না। বাবাও চাইতেন ছেলে চাকরিতে মনোযোগী হোক, এসব ব্যায়াম আর অভিনয়ের ভূত মাথা থেকে বার করে।

কলেজে ভর্তি হয়ে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নাটকের দল। মহড়া চলত আশুতোষ কলেজের ছাদে। বাবা জিতেন্দ্রনাথ এসব একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্নারানিকে বলতেন, 

— “অভিনয় কইব়্যা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কইয়্যা দিও, ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিল দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতন চেহারা।” 

কিন্তু এসব অভাব-অনটন-দুর্যোগ কাটিয়ে রবি ঘোষ বডিবিল্ডার হতে পেরেছিলেন। যে কারও চোখ ঝলসে যেত রবির পেশি ফোলানো চেহারা দেখে। কোন বাঙালি ছেলের অমন চেহারা দেখা দুর্লভ তখন।

১৯৫৩ সালে কলকাতা পুলিশ-কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সেসব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। অভিনয়জীবন শুরু পঞ্চাশের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। পরিচালক ছিলেন উৎপল দত্ত।

রবি ঘোষের ছবি করা শুরু হয় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'কিছুক্ষণ' ছবি দিয়ে। সে ছবি আজ লুপ্ত। এটি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়রও একক পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি। তাঁর সমসাময়িক হিরোদের চেয়ে অনেক সুগঠিত ছিল রবি ঘোষের শরীর, আজকাল যাকে বলে জিমচর্চিত ফিজিক। কিন্তু তখন অভিনয়টাই আসল ছিল, শরীর প্রদর্শন নয়। সে জন্য কোনও কাজেই লাগেনি তাঁর বডি বিল্ডিং। তখনও জিমে ঘাম ঝরানো ছবি অভিনেতাদের অন্যতম মূলধন হয়ে ওঠেনি। সে সময়ে হিরোদের বাহুবলী হওয়ার দরকার পড়ত না। দরকার পড়ত অভিনয়ের, আর খানিকটা সুন্দর মুখেরও।

রবি ঘোষের 'সুন্দর মুখ' ছিল না, তাই নায়ক হওয়া হয়নি। উত্তম-সৌমিত্র-বসন্ত যুগে পেলেন না রবি নায়কের রোল। বাবার ভবিষ্যৎ বাণীই সত্যি হল। কিন্তু রবি তাঁর প্যাশন বিসর্জন দিলেন না। অভিনয়টা তো খাঁটি, যেটা দিয়েই লেজেন্ড হয়ে রইলেন। না, রোম্যান্টিক হিরো তাঁর হওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি যে কোনও রোলকেই দুর্দান্ত করে তুলতেন। পোস্টারে তাঁর ছবি উত্তম-সৌমিত্রর পাশে জায়গা পেল কিনা, সেই নিয়েও মাথা ঘামাতেন না। কাজটাকেই সাধনা মনে করতেন। এই শিক্ষা রবি ঘোষ দিয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্য খরাজ মুখোপাধ্যায়কেও।


তবে 'গল্প হলেও সত্যি'র ধনঞ্জয় তো নায়কই। হিন্দিতে যখন 'গল্প হলেও সত্যি'র রিমেকে 'বাবুর্চি' হলেন রাজেশ খান্না, সে তো কাকের গায়ে ময়ূরপুচ্ছ লাগানো হল। রাজেশ খান্না সুপারস্টার হিরো কিন্তু সেই স্টারডমে যেন ধনঞ্জয়ই এগিয়ে রইলেন। এখানেই রবি ঘোষের জয়। যদি হিন্দি রিমেকেও রবি ঘোষ থাকতেন তাহলে হয়তো ছবিটা অন্য ইতিহাস করত। কিন্তু বলিউড প্রযোজকরা একজন আঞ্চলিক অভিনেতার উপর ভরসা করতে পারেননি...


সত্যজিৎ বাবুর 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে রবি ঘোষ মাতাল বন্ধুদের সঙ্গে থেকেও মদ্যপান করেননি ৷ নারীঘটিত কামুক আসক্তি থেকে বঞ্চিত থেকে সকল বন্ধুদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। সম্পূর্ণ ফ্রি, সম্পূর্ণ স্বাধীন চরিত্র ছিল ছবিতে৷ বাস্তবেও শেষ জীবন অবধি কাজ করে গেছেন নিজের শর্তে। তাঁর শেষ কাজ কলকাতা দূরদর্শনে 'গোপাল ভাঁড়', তা দেখতে প্রতি রোববার দুপুরে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত।


চোখধাঁধানো বডি বিল্ডার হয়েও, সেটি বাংলা ছবিতে বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে, 'হরিপদ একজন বেঁটেখাটো সাদামাটা লোক' – সম রবি ঘোষ অভিনয়টাকেই তাঁর পেশিশক্তি বানিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী বৈশাখী দেবী আজও জীবিত। কিন্তু কলকাতা শহরে রবি ঘোষকে নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান নেই, চর্চা নেই। লেজেন্ডরা সরকারি স্বীকৃতি কবেই বা পেয়েছেন! তবু দর্শক মনে তাঁদের চির-উজ্জ্বল উপস্থিতিই যেন আসল পুরস্কার..

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন